Vidyasagar-biography
Category – Biography
Ishwar-Chandra-Vidyasagar
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ভারতমাতার প্রবাদ প্রতিম সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর কথা যতই বলা হোক তাও যেন কম পড়ে যায়। আমরা এই প্রবন্ধে বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের কাছে এই মহান মানুষটির জীবন সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করলাম।

উনিশ শতকের ভারতে একজন বিশিষ্ট বাঙালি দার্শনিক, লেখক, শিক্ষাবিদ এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। একটি সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে ঈশ্বরচন্দ্র কিভাবে ‘বিদ্যাসাগর’ হয়ে উঠল সেই গল্পই রইল তোমাদের জন্য।

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মগ্রহণ

1820 সালের 26শে সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বাংলার মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জন্মের পর তাঁর পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ বিদ্যাসাগরের নাম রাখেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সর্বজনবিদিত ‘বিদ্যাসাগর’ নামটি তিনি উপাধি হিসাবে পেয়েছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরিবার

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাতা ভগবতী দেবী এবং পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পিতা কলকাতায় স্বল্প বেতনের একটি চাকরি করতেন। তাঁর পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকতেন বলে তাঁর শৈশব বীরসিংহ গ্রামে মা ও ঠাকুরমার সঙ্গে কেটেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষাজীবন

বিদ্যাসাগর শিশু বয়স থেকেই অত্যন্ত কষ্ট ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছেন। আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং জ্ঞানের প্রতি প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাঁকে সকলের মাঝে আলাদা স্থান দিয়েছে।

তাঁর শিক্ষার প্রতি এই আগ্রহ ও দক্ষতা দেখে গ্রামের স্কুলের শিক্ষক তাঁকে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে পড়ার ব্যবস্থা করে দেন। 1829 সালে মাত্র 9 বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন।

ব্যাকরণ পড়তে পড়তে তিনি 1830 সালে সংস্কৃত কলেজের ইংরাজি শ্রেণিতেও ভর্তি হন। তাঁর ইংরাজি পড়ার পিছনে একটি ছোটো মজার ঘটনা রয়েছে। 1828 সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পিতার সঙ্গে পদব্রজে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরাজি সংখ্যাগুলি দেখে তিনি ইংরাজি সংখ্যা পড়তে শিখেছিলেন এবং এই ঘটনার পর থেকেই ইংরাজি ভাষা শেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মায়।

পড়াশোনার প্রতি তাঁর এতটাই আগ্রহ ছিল যে তাঁর দারিদ্র তাঁকে বিদ্যার্জনের পথে বাঁধা দিতে পারেনি। রাতের বেলা ঘরে আলোর অভাব থাকায়, রাস্তার লাইটপোস্টের নীচে বসে তিনি পড়াশোনা করতেন।

vidyasagar-image
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

তাঁর সাংঘাতিক বুদ্ধিমত্তা ও অসাধারণ পান্ডিত্যের কারণে তিনি অনেক ছোটো বয়স থেকেই বৃত্তি বা স্কলারশিপ (Scholarship) পেতেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 1839 সালের 22 এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন। এই পরীক্ষাটিতে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন এবং এরপরই তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি লাভ করেন। এরপর থেকে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নাম ব্যবহৃত করেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা নামেও পরিচিত ছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কর্মজীবন

শিক্ষাজীবন শেষ করার পর, মাত্র 21 বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেড ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু শিক্ষাবিস্তার, সমাজ সংস্কার তথা জগতের কল্যাণসাধনই যে তাঁর প্রকৃত আকর্ষণের স্থান তা উপলব্ধি করেন। 1850 সালে, তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন, যেখানে তিনি বেশ কয়েকটি প্রগতিশীল সংস্কার প্রবর্তন করেন। যেমন অব্রাহ্মণ ছাত্ররাও তাঁর সময়কাল থেকে এই কলেজে পড়াশোনা করতে পারত। শুধুমাত্র তাই নয় সেই উনিশ শতকে সংস্কৃত ভাষার প্রবল প্রতিপত্তির মধ্যেও, শিক্ষাবিস্তারে মাতৃভাষার গুরুত্ব তিনিই প্রথম বুঝেছিলেন। তাই বাংলা ভাষায় শিক্ষা বিস্তারের সবরকম প্রচেষ্টাই তিনি করেছিলেন।

careerbondhu.com whatsapp channel

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উল্লেখযোগ্য কাজ

যে নারীমুক্তির আন্দোলন শুরু করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের হাতে যেন সেই আন্দোলন পূর্ণতা পায়। সতীদাহ বন্ধ হয়েও জীবন্ত মেয়ে গুলোর দুর্দশা বিন্দুমাত্র ঘুঁচলনা। আগে আগুনে পুড়ে তাদের মরতে হত, সতীদাহ রদের পরে তাদের সংসারের আগুনে দগ্ধাতে হত। অকাল বৈধব্য, একাদশী পালন, অশিক্ষা, ব্রাহ্মণদের কুলীন প্রথার বলিদান হতে হতে নারীদের অবস্থা হয়ে উঠেছিল ভয়াবহ। আর এই অসহায় মেয়েগুলোকে রক্ষা করতেই যেন “ঈশ্বর এক ঈশ্বর কে পাঠিয়েছিলেন”।

Widows' Remarriage
বিধবা বিবাহ ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি আঁকা ছবি।

সমাজে প্রচলিত বহুবিবাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, বিধবাদের প্রতি নিন্দনীয় অত্যাচারের বিরূদ্ধে এই ‘বীরসিংহের সিংহ’ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর সামাজিক রীতিনীতি এবং রক্ষণশীল ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ করে বিধবাদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন এবং তাদের পুনর্বিবাহের অধিকারের জন্য শাস্ত্র মেনে যুক্তি দিয়েছিলেন। বহু লড়াই এবং বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে 1856 সালে বিধবা পুনর্বিবাহ বা বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়, যা হিন্দু বিধবাদের পুনরায় বিয়ে করতে এবং সামাজিক স্বীকৃতি লাভের অনুমতি দিয়েছিল।

এছাড়াও বিদ্যাসাগর নারীদের শিক্ষালাভেও যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। তিনি মহিলাদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর একার উদ্যোগেই তিনি বহু জেলায় বহু স্কুল তৈরি করেন। তিনি মনে করতেন কোনো দেশের অর্ধেক সমাজ অশিক্ষায় ডুবে থাকলে সেই দেশের উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়। জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমাজের সকলের মধ্যে তাই তিনি শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে চেয়েছিলেন।

কলেজের অধ্যক্ষ ও সমাজ সংস্কারের সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক ও পণ্ডিত যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচারে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি বাংলা বর্ণমালার সংশোধন ও সরলীকরণ করেন, এবং একে জনসাধারণের কাছে আরও সহজলভ্য করে তোলেন।

Bornoporichoy
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা বর্ণপরিচয়

তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হল “বর্ণপরিচয়”, যা আজও বাংলা শেখার প্রাথমিক পদক্ষেপ। প্রায় সব শিশুই শিক্ষালাভের প্রথম ধাপে এই বই পড়ে তার ভাষা শিক্ষা শুরু করে।

তিনি বহু স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিলেন। 1872 সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে ভারতবর্ষে প্রথম প্রাইভেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, তার নাম ছিল মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (Metropolitan Institution)। তিনি এই কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। 1917 সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মরণে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের নাম পরিবর্তিত হয়ে বিদ্যাসাগর কলেজ (Vidyasagar College) হয়।

বিদ্যাসাগর কলেজ সম্পর্কে আরো জেনে নাও – বিদ্যাসাগর কলেজ | Vidyasagar College সম্পর্কে কিছু তথ্য আলোচনা
Vidyasagar-College
ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যু

1891 সালে 29 জুলাই কলকাতার বাদুড়বাগানস্থ বাসভবনে লিভারের ক্যানসারের কারণে 70 বছর বয়সে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম এই মহান ব্যক্তি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রয়াত হন।

অসংখ্য চ্যালেঞ্জ এবং বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও, বিদ্যাসাগর তাঁর সমাজ সংস্কার এবং জ্ঞানার্জনের সাধনার পথ থেকে সরে আসেননি ছিলেন। বাংলা মায়ের চোখের জল মোছানোই যেন ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। এই বিরাট পণ্ডিতের কোমল হৃদয় ভারতমাতার ন্যায় হলেও পৌরুষ ছিল ব্রিটিশদের মত।

অসম্ভব প্রতিকুলতা সরিয়ে দিয়ে কিভাবে নিজের কাজের মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনী থেকে শিখতে পারি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংগ্রাম প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে শিক্ষা ও সংকল্পের শক্তির স্মারক হিসাবে আগামী দিনেও একইভাবে কাজ করে যাবে।

পর্ব সমাপ্ত! আরো পড়ুন – এ.পি.জে আবদুল কালামের জীবনী 


নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য ফলো করুন

WhatsApp Channel | Telegram Channel | Facebook Page


careerbondhu-telegram-channel

বিশেষ দ্রষ্টব্য

  • এই নিবন্ধে ব্যবহৃত তথ্য ইন্টারনেট, সংবাদ পত্র, পত্রিকা, প্রকাশিত রিপোর্ট ইত্যাদি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। নিবন্ধে ব্যবহৃত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কোর্সের নাম ইত্যাদি শুধুমাত্র শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। এই ব্যাপারে আরো জানার জন্য এই পাতাটি পড়ে নেবার অনুরোধ রইল → Disclaimer
  • নিবন্ধটি আমরা যথাসম্ভব ত্রুটি মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছি, তথ্যে কোনরূপ ত্রুটি চিহ্নিত হলে তা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি হিসাবে গণ্য হবে, চিহ্নিত ত্রুটি এই পাতা থেকে তা আমাদের জানানো যেতে পারে → Report an error
error: Content is protected !!